1. live@www.chitrarpar.com : news online : news online
  2. info@www.chitrarpar.com : চিত্রারপাড় :
রবিবার, ২৬ জানুয়ারী ২০২৫, ১১:২৯ পূর্বাহ্ন

আওয়ামী চেরাগে দোকানদার থেকে হাজার কোটির মালিক

প্রতিবেদকের নাম:
  • প্রকাশিত: শনিবার, ১৯ অক্টোবর, ২০২৪
  • ৪২ বার পড়া হয়েছে

শাহীন চাকলাদার। যশোরের অলিখিত এক অধিপতির নাম। এক সময় শহরের এমএম আলী রোডে বাবার রেখে যাওয়া একটি ওষুধের দোকান চালাতেন তিনি। আওয়ামী লীগের এমপি হয়ে দলটির প্রভাবকে আলাদীনের চেরাগ বানিয়ে সেই দোকানি গত ১৫ বছরে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, চোরাচালান, দখলবাজি করে অন্তত হাজার কোটি টাকার সম্পদের পাহাড় গড়েন; হয়ে ওঠেন পুরো যশোরের নিয়ন্ত্রক। স্থানীয়দের কাছে তার পরিচিতি ছিল সন্ত্রাসীদের গডফাদার হিসেবে। ভিন্নমত দমনে সব সময় সন্ত্রাসী বাহিনী ব্যবহার করতেন শাহীন চাকলাদার; এ জন্য টর্চার সেলও ছিল তার। যার ইশারায় গত ১৫ বছর যশোর চলেছে।

গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগসরকারের পতনের পর থেকে তাকে যশোরে আর দেখা যায়নি। শাহীন চাকলাদার দেশেই গা ঢাকা দিয়ে আছেন, নাকি সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে পালিয়ে গেছেন তা নিয়ে যশোরে ব্যাপক আলোচনা চলছে। সর্বশেষ, দুর্নীতি দমন কমিশন তার সম্পদের অনুসন্ধান শুরু করেছে। ইতোমধ্যে শাহীন চাকলাদার এবং তার স্ত্রী ও সন্তানের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞাও জারি করা হয়েছে।

যশোর জেলা আওয়ামী লীগে ‘হঠাৎ আগন্তুক’ শাহীন চাকলাদার। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি ক্ষমতায় এলে ঠিকাদারি ব্যবসায় নামেন। তৎকালীন যশোরের বিএনপি নেতাদের সুবিধা দিয়ে ঠিকাদারি করে অর্থবিত্ত গড়ে তোলেন। হঠাৎ ২০০৩ সালে যশোর জেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক কমিটিতে স্থান করে নেন তিনি। সবাইকে চমকে দিয়ে পরের বছর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হয়ে যান। মূলত তখন থেকেই শুরু শাহীন চাকলাদারের একক আধিপত্য বিস্তারের রাজনীতি। তার এই পথে যারা বাধা হয়েছিলেন তাদের সরাতে বিশাল সন্ত্রাসী বাহিনী গড়ে তোলেন। একপর্যায়ে শাহীন চাকলাদার নিজেই সন্ত্রাসীদের গডফাদারে পরিণত হন। তিনি নিজেও সব সময় সন্ত্রাসীদের ভয়ে আতঙ্কিত থাকতেন। তার বাড়ি ও অফিসে বসানো সিসি ক্যামেরা এবং চলাফেরার ধরন দেখেই এ সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায়। নিরপত্তার জন্য সরকার অনুমোদিত গানম্যান ছিল তার। এর বাইরেও তিনি যখন চলাফেরা করতেন, তার আগে-পিছে গোটা দশেক মোটরসাইকেলের বহর দেখা যেত।

শাহীন চাকলাদার ছিলেন যশোর সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও যশোর-৬ (কেশবপুর) আসনের সংসদ সদস্য। অন্যকে দমন করে রাজনীতিসহ সব সেক্টরে একক আধিপত্য বিস্তারে তিনি সন্ত্রাসীদের ব্যবহার করতেন। রাজনৈতিক দলের সাইনবোর্ড ব্যবহার করে বেআইনি ও অবৈধ পন্থায় সম্পদের পাহাড় গড়েন শাহীন। যশোরের রাজনীতি, টেন্ডার ব্যবসা, চাঁদাবাজি, চোরাচালান, দখলবাজিসহ সব সেক্টরে একক আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় চিহ্নিত অপরাধীদের নিয়ে তিনি গড়ে তোলেন আলাদা আলাদা টিম। সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আরবপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান শাহারুল ইসলাম, শাহীন চাকলাদারের চাচাতো ভাই সদর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান তৌহিদ চাকলাদার ফন্টু ওরফে ফন্টু চাকলাদার, জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি রওশন ইকবাল শাহী, সাবেক সাধারণ সম্পাদক সদর উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন বিপুল এসব গ্রুপের নেতৃত্বে ছিলেন।

অভিযোগ রয়েছে, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠেন শাহীন চাকলাদার। ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে শাহীন চাকলাদার অবৈধভাবে অঢেল বিত্তবৈভবের মালিক হন। তিনি শহরের কাজীপাড়ায় পৈতৃক বাড়ির বাইরেও বহু স্থানে বানিয়েছেন বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য শহরের চিত্রা মোড়ে ১৭ তলাবিশিষ্ট পাঁচতারকা হোটেল, কাঁঠালতলায় অত্যাধুনিক আলিশান তিনতলা ও বড় বাজারে দোতলা বাড়ি। কিনেছেন যশোরের ঐতিহ্যবাহী পারভীনা হোটেল। আরবপুর মোড়ে রয়েছে পাঁচতলা বাড়ি, বিমান অফিসের পাশে রয়েছে বাড়িসহ জমি, মাইকপট্টিতে তারই সহযোগী সাবেক কাউন্সিলর আলমগীর কবির সুমন ওরফে হাজী সুমনের সাথে যৌথ নামে জমি, পেট্রলপাম্প, ধর্মতলায় জমি, ঢাকার মহাখালীর ডিওএইচএসে ফ্ল্যাট। এর বাইরেও আত্মীয়স্বজনের নামে দেশে-বিদেশে বিপুল সম্পদ গড়েছেন শাহীন।

অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, আনোয়ারা বেগম নামে একজন স্কুলশিক্ষিকা শহরের চিত্রা মোড়ে তার জমি দখলদারদের হাত থেকে মুক্ত করতে সহযোগিতার জন্য গিয়েছিলেন শাহীন চাকলাদারের কাছে। একপর্যায়ে কোটি টাকা মূল্যের ওই জমি থেকে আগের দখলদারের পাশাপাশি ওই শিক্ষিকাকেও উচ্ছেদ করে নিজেই এ জমি দখল করে নেন শাহীন চাকলাদার। সেই জমিতে তিনি গড়ে তোলেন ১৭ তলাবিশিষ্ট ফাইভ স্টার হোটেল ‘জাবির ইন্টারন্যাশনাল’। যা জুয়া ও বড় বড় অনৈতিক কাজের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। ৫ আগস্ট ওই হোটেলে আগুন ধরিয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা। এতে একজন বিদেশিসহ ২৪ ব্যক্তির মৃত্যু হয়। অভিযোগ রয়েছে হোটেলের পাশে গাজী ইলেকট্রিকের দোতলা মার্কেটের একটি বড় অংশও তিনি দখল করে নেন।

জানা গেছে, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ের সামনে ২০০ বিঘার এড়োলের বিল, মাহিদিয়ায় ১০০ বিঘার বিলের জমি, জগহাটির একটি বিল, শহরের মাইকপট্টির সেলিম নামে এক ব্যক্তির মার্কেটের একাংশ, কাঁঠালতলা এলাকার ঈদগাহের একটি অংশ, শহরের ঘোষপাড়া এলাকার সাধন নামে এক ব্যক্তির ১৫ বিঘা জমি, বকচরে সরকারি জায়গা দখল করে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নির্মাণ, যশোর নড়াইল রোডের বীজ গোডাউনের সামনে সড়ক ও জনপথ বিভাগের জায়গা দখল করে মার্কেট নির্মাণের অভিযোগ রয়েছে শাহীন চাকলাদার গংয়ের বিরুদ্ধে।

এসব ছাড়াও সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের নিলামে চাকলাদারের লোকজন ছাড়া আশপাশে আর কাউকে ভিড়তে দেওয়া হতো না। যশোরের ভূমি অফিস, রেজিস্ট্রি অফিস, পাসপোর্ট অফিস, বিআরটিএ অফিস, সেটেলমেন্ট অফিস, বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিক মালিকরা শাহীনের লোকজনকে নিয়মিত চাঁদা দিতে বাধ্য হতেন। এমনকি কোচিং সেন্টারও তাদের চাঁদাবাজির বাইরে ছিল না। শহরের ৬টি প্রবেশমুখ মুড়লী, চাঁচড়া চেকপোস্ট, পালবাড়ি, খাজুরা বাসস্ট্যান্ড ও মণিহারসহ মূল শহরের মোড়ে মোড়ে বিভিন্ন যানবাহন থেকে নিয়মিত চাঁদা তুলতেন চাকলাদারের ক্যাডাররা। এমনকি ইজিবাইক, রিকশা ও ভ্যানচালকরাও চাঁদা দিতে বাধ্য হতেন। যশোরের সব সরকারি দপ্তরের টেন্ডার নিয়ন্ত্রিত হতো শাহীন চাকলাদারের বাড়ির কাঁঠালতলা থেকে। চাকলাদারের প্রভাব খাটিয়ে তার ভাই সাবেক পৌর মেয়র রেন্টু চাকলাদার, কাউন্সিলর হাজী সুমন, মোস্তফা, সন্তোষ দত্ত, জাহিদ হোসেন মিলন ওরফে টাক মিলন, চুড়ামনকাটি ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল মান্নান মুন্না, মশিয়ার রহমান সাগর, শাহারুল ও বিহারি ক্যাম্প এলাকার রবি নিরীহ মানুষের সম্পত্তি দখল করতেন বলে অভিযোগ রয়েছে। চাকলাদারের পৃষ্ঠপোষকতায় তার বাহিনী খুনোখুনিতেও ছিল বেপরোয়া। তাদের বিরুদ্ধে বহু হত্যাকা-ে সম্পৃক্ততার অভিযোগ রয়েছে। তার বাহিনীর অনেকেই হত্যা মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি। শাহীন চাকলাদার ক্ষমতায় থাকালে বিভিন্ন সমাবেশে তিনি বিরোধী রাজনৈতিক মত-পথের লোকজনকে প্রকাশ্যে দেখে নেওয়ার হুমকি দিতেন। আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতাকর্মীরা বরাবরই তার কাছে ছিলেন উপেক্ষিত। নিজের অনৈতিক কর্মকা- নির্বিঘœ করতে শাহীন চাকলাদার সব জায়গায় বিতর্কিতদের বসিয়ে রেখেছিলেন।

যশোর সরকারি এমএম কলেজের দুটি ছাত্রাবাস ছিল শাহীন চাকলাদারের ক্যাডার বাহিনীর দখলে। এখান থেকে শহরের সব মেস নিয়ন্ত্রণ করা হতো। শিক্ষার্থীদের শাহীন চাকলাদারের মিছিলে যেতে বাধ্য করা হতো। ছাত্রলীগের নামধারীরা নিয়ন্ত্রণ করতো সব ক্যাম্পাস। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রশাসনও চলতে বাধ্য হতো তাদের ইশারায়। কলেজের ৪টি পুকুর চাকলাদারের অনুসারী জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি রওশন ইকবাল শাহী ও সাবেক সাধারণ আনোয়ার হোসেন বিপুল দখল করে বিনা ইজারায় মাছ চাষের ব্যবসা করেছেন।

যশোর-৩ (সদর) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য কাজী নাবিল আহমেদের সঙ্গে শাহীন চাকলাদারের ছিল দা-কুমড়া সম্পর্ক। সদরে দলীয় মনোনয়ন নিয়েই মূলত দুজনের মধ্যে বিরোধ তুঙ্গে ছিল। যশোর-৬ আসনের সাবেক এমপি ইসমাত আরা সাদেকের মৃত্যুর পর সেখানে উপনির্বাচনে দলীয় হাইকমান্ড শাহীন চাকলাদারকে প্রার্থী করে। ২০২০ সালের উপনির্বাচনে তিনি এমপি নির্বাচিত হন।

অভিযোগ রয়েছে, কেশবপুরের এমপি থাকাকালে তিন বছরে শাহীন চাকলাদার নিয়োগবাণিজ্য করেছেন তিন শতাধিক। প্রতিটি নিয়োগে ৮ লাখ থেকে ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত বখরা নিয়েছেন তিনি। সরকারি কাবিখা কাবিটাসহ সব প্রকল্প সম্পন্ন করতেন মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে। ক্ষমতার দাপটে তিনি একের পর এক দখল করতে থাকেন সেখানকার সব মাছের ঘের। তার অপকর্মে স্থানীয় রাজনীতিবিদসহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। তারই ফলে ২০২৪ সালের নির্বাচনে দলীয় নৌকা প্রতীকের প্রার্থী হয়েও একই দলের স্বতন্ত্র প্রার্থী বয়সে তরুণ আজিজুল ইসলাম ওরফে খন্দকার আজিজের কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হন শাহীন।

শাহীন চাকলাদারের সন্ত্রাসী কর্মকা-ের ব্যাপারে জাতীয় সংসদে কথা বলেছিলেন যশোর-৩ (সদর) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য কাজী নাবিল আহমেদ। এ ছাড়া একটি গোয়েন্দা সংস্থা তার সন্ত্রাস, দখল, চাঁদাবাজির রাশ টেনে ধরতে কয়েক বছর আগে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে একটি প্রতিবেদন দাখিল করেছিল। কিন্তু শাহীন চাকলাদারের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই গ্রহণ করা হয়নি। উল্টো তাকে এমপি প্রার্থী করে পৃষ্ঠপোষকতা করা হয় আওয়ামী লীগের শীর্ষপর্যায় থেকে।

রাজনৈতিক নেতার সাইনবোর্ডে সীমাহীন বেআইনি ও অপরাধমূলক কর্মকা-ের মাধ্যমে অঢেল সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলা শাহীন চাকলাদারের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে এখন চলছে দুদকের অনুসন্ধান। অনুসন্ধান কর্মকর্তা দুদকের উপ-পরিচালক মো. শফিউল্লাহ আমাদের সময়কে বলেন, শাহীন চাকলাদারের সম্পদের অনুসন্ধান চলমান রয়েছে। স্ত্রী-সন্তানসহ তার দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। অন্যদিকে তার ব্যাংক হিসাব জব্দ করার জন্য বিএফআইইউতে চিঠি দেওয়া হয়েছে।

শাহীন চাকলাদার দেশে না বিদেশে, এ নিয়ে দুই ধরনের তথ্য মিলছে। কেউ বলছেন, তার ফাইভ স্টার হোটেলের ম্যানেজার কলকাতার বাসিন্দা হওয়ায় তার মাধ্যমে তিনি পুটখালী সীমান্ত হয়ে ভারতে পাড়ি জমিয়েছেন। কেউবা বলছেন, জনগণ ও প্রশাসনের দৃষ্টি ভিন্ন খাতে নিতে ভারতে যাওয়ার কথা প্রচার করে যশোরেই আত্মগোপনে আছেন তিনি। এ শহরে বসেই এখনো সব কার্যক্রম পরিচালনা করছেন শাহীন।

নানা অভিযোগের বিষয়ে শাহীন চাকলাদারের বক্তব্য নিতে তার ব্যক্তিগত ফোনে বারবার যোগাযোগ করা হলেও নম্বরটি বন্ধ পাওয়া গেছে।

তথ্য সুত্র ঃ আমাদের সময় 

সংবাদটি শেয়ার করুন

আরো সংবাদ পড়ুন

পুরাতন সংবাদ পড়ুন

সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০১১১২
১৩১৪১৫১৬১৭১৮১৯
২০২১২২২৩২৪২৫২৬
২৭২৮২৯৩০৩১  
© সমস্ত অধিকার সংরক্ষিত
প্রযুক্তি সহায়তায়: ইয়োলো হোস্ট