ক্ষণগণনা, দিন গণনা শেষ। আগামীকাল বৃহস্পতিবার আসছে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের নতুন বাজেট। সংকটময় ও চ্যালেঞ্জিং সময়ে বেশ হিসাব-নিকাশ করে সরকার দিতে যাচ্ছে নতুন বাজেট। সরকারের ‘টানাটানির সংসারে’ কীভাবে আয় বাড়ানো যায়, সে চেষ্টাই থাকবে এবার। আর এই আয় বাড়াতে করে বেশি নজর দিচ্ছে সরকার। এ জন্য কর ও ভ্যাট কাঠামোতে আনা হচ্ছে ব্যাপক পরিবর্তন। অনেক খাতেই তুলে নেওয়া হবে করছাড় সুবিধা। বাড়ানো হবে কর ও ভ্যাটের হার এবং আওতা। অর্থ মন্ত্রণালয় ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে নতুন বাজেট সম্পর্কে এসব তথ্য জানা গেছে।
এদিকে আজ বুধবার শুরু হচ্ছে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট অধিবেশন। আর আগামীকাল বৃহস্পতিবার বেলা ৩টায় জাতীয় সংসদে ৭ লাখ ৯৬ হাজার ৯০০ কোটি টাকা ব্যয়ের বাজেট উপস্থাপন করবেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তব্যের শিরোনাম ‘সুখী, সমৃদ্ধ, উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অঙ্গীকার’। নতুন বাজেটের জন্য রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা থাকছে ৫ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা। বাকি ২ লাখ ৫৭ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা থাকবে।
অবশ্য অর্থনীতিবিদরা বলছেন, অনেক চ্যালেঞ্জ মাথায় নিয়ে নতুন অর্থবছরের বাজেট দিতে হবে সরকারকে। এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম সময়ের আলোকে বলেন, ‘একদিকে অর্থনৈতিক খাতের সংস্কারের জন্য দাতা সংস্থা আইএমএফের নানামুখী চাপ, অন্যদিকে উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপ রয়েছে সরকারের ঘাড়ে। এর বাইরে ব্যাংক ও আর্থিক খাতের ভঙ্গুর অবস্থা, শেয়ারবাজার মৃতপ্রায়, বিনিয়োগে স্থবিরতা, নতুন কর্মসংস্থানও কমে গেছে। এত এত সংকটের মধ্যে সরকারকে এবারের বাজেট দিতে হচ্ছে। সরকারের হাতে অর্থেরও টানাটানি রয়েছে।
কাজেই নতুন বাজেটে সরকার আয় কীভাবে বাড়ানো যায় সেদিকেই বেশি জোর দেবে। আর সরকারের আয় বাড়ানোর প্রধান হাতিয়ার কর ও ভ্যাট। কাজেই জাতীয় রাজস্ব বোর্ড যে এবার সরকারের আয় বাড়াতে বেশ নির্দয় হবে সেটি অনুমেয়। অর্থাৎ দেশের মানুষের ওপর করের বোঝা আরও বাড়বে-এটি নিশ্চিত করে বলা যায়।
তিনি আরও বলেন, এমনিতেই খাদ্যপণ্যের উচ্চ মূল্যের কারণে দেশের মানুষ কষ্টে আছে। এর পর যদি করের বোঝা আরও বাড়ে তা হলে তাদের জীবনযাপন আরও কঠিন হবে। তাই সরকারের লক্ষ্য থাকা উচিত-আয় বাড়াতে হয়তো কর ও ভ্যাট বাড়ানোর বিকল্প কোনো পথ নেই সরকারের সামনে, তবে মানুষ যাতে কম দামে অন্তত খাদ্যপণ্য কিনতে পারে সে জন্য বাজেটে অতি গুরুত্বপূর্ণ কিছু পণ্যের ওপর ভ্যাট-ট্যাক্স কমাতে হবে নতুন বাজেটে।’
এদিকে নতুন বাজেটে মানুষের ওপর করের বোঝা একদিকে যেমন বাড়বে, অন্যদিকে করমুক্ত আয়সীমাও বাড়ছে না এবারের বাজেটে। কিন্তু সরকারের পরিচালন ব্যয় ঠিকই বাড়ছে। অন্যদিকে সরকারের ঋণ সরবরাহের ক্ষেত্রেও লাগাম টানবে এবার। এতে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ আরও বাধাগ্রস্ত হতে পারে। ফলে নতুন কর্মসংস্থানও কমতে পারে। এ ছাড়া ভর্তুকি ও প্রণোদনা কমাতে আইএমএফের চাপ থাকার পরও নতুন বাজেটে বাড়ছে ভর্তুকি ও বিভিন্ন খাতের প্রণোদনা।
জানা গেছে, রাজস্ব বাড়ানোর ক্ষেত্রে করের আওতা সম্প্রসারণ, কর প্রশাসনের সংস্কার ও আদায় প্রক্রিয়া স্বয়ংক্রিয়করণের পাশাপাশি কর অব্যাহতি ও শুল্ক-কর ছাড় আগামী তিন অর্থবছরের মধ্যে শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার পরামর্শ দিয়েছে আইএমএফ। গত নভেম্বরে এনবিআরের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রত্যক্ষ করব্যয়ের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ২৫ হাজার ৮১৩ কোটি টাকা। এনবিআর এবারই প্রথম আগামী বাজেটে কর অব্যাহতি ও শুল্ক-কর ছাড় কমিয়ে অন্তত বাড়তি ১৫ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয়ের কৌশল গ্রহণ করেছে। তৈরি পোশাক, ক্ষুদ্রঋণ, রেমিট্যান্স, পোল্ট্রি ও ফিশারি খাতেও করছাড় কমানো হতে পারে। নতুন বাজেটে অনেক পণ্যেই উৎপাদনে ভ্যাটের হার ৫ শতাংশ থেকে ১৫ শতাংশ করার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। নিরাপত্তা সেবার ১০ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট দিতে হয়। আগামী বাজেটে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করার পরিকল্পনা করছে এনবিআর। নতুন ভ্যাট আইনে ১৫ শতাংশকে আদর্শ ভ্যাটহার ধরা হলেও নানা কারণে বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। এ জন্য একাধিক হারে ভ্যাট আদায় হচ্ছে। আগামী বাজেটে এ হার কিছুটা যৌক্তিক করা হবে। এ ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় পণ্যে ভ্যাট হার বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে এনবিআরের। ২০২৬ সাল নাগাদ পর্যায়ক্রমে সব পণ্য ও সেবার ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট হার আরোপের পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। শূন্য শুল্কের অর্ধশতাধিক পণ্যে আগামী অর্থবছর থেকে ১ শতাংশ হারে আমদানি শুল্ক আরোপ হতে পারে।
আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত এসি উৎপাদনে ভ্যাট অব্যাহতি রয়েছে। এর মেয়াদ আর না বাড়িয়ে নতুন অর্থবছরে ৫ শতাংশ ভ্যাট বসতে পারে। ফ্রিজ উৎপাদনে ভ্যাটের হার বিদ্যমান ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হতে পারে। কাজেই এসব পণ্যের দাম বাড়বে বাজেটে। মোবাইল ফোনে কথা বলা বা ইন্টারনেটের ওপর বাড়তি ৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর ঘোষণা আসতে পারে। মোবাইল অপারেটরদের সিমকার্ড বিক্রির ওপর কর ২০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩০০ টাকা হতে পারে। ফলে মোবাইলে কথা বলার খরচ বাড়তে পারে এবারের বাজেটে।
জানা গেছে, নানাভাবে করজাল বাড়লেও নতুন বাজেটে করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ছে না। অন্যদিকে বিত্তশালীদের কাছ থেকেও বাড়তি কর আদায়ের পদক্ষেপ থাকছে। বর্তমানে বার্ষিক আয় সাড়ে ১৬ লাখের বেশি হলে ২৫ শতাংশ হারে কর দিতে হয়। আগামী বাজেটে সাড়ে ৩৮ লাখ টাকা পর্যন্ত আয়ের ক্ষেত্রে করহার রাখা হচ্ছে ২৫ শতাংশ। তবে এর বেশি আয়ের ক্ষেত্রে তা বাড়িয়ে ৩০ শতাংশ করা হচ্ছে। এ ছাড়া পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করে ৫০ লাখ টাকার বেশি মুনাফার ওপর ‘ক্যাপিটাল গেইন’ কর আরোপের সিদ্ধান্ত আসতে পারে। এ হার হতে পারে ১৫ শতাংশ। করের আওতা বাড়াতে কমিউনিটি সেন্টার ভাড়া আরও কিছু সেবায় রিটার্ন জমার সনদ প্রদান বাধ্যতামূলক হতে পারে।
জনগণের ওপর করের বোঝা বাড়লেও সরকার ঠিকই তার পরিচালন ব্যয় বাড়াচ্ছে। এ জন্য সরকারের পরিচালন ব্যয়ের আওতায় আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে ‘পণ্য ও সেবা’র ক্রয় খাতে ৪৭ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করার পরিকল্পনা করছে, যা চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে প্রস্তাবিত ব্যয়ের তুলনায় ২ হাজার ৭৬৮ কোটি টাকা বেশি। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে পণ্য ও সেবার আওতায় সরকারের ব্যয়ের লক্ষ্য ধরা হয় ৪৪ হাজার ২৩২ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে এ ব্যয় সামান্য কমিয়ে ৪৩ হাজার ৮৮১ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়।
এদিকে অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, এবারের বাজেটে ঋণ সরবরাহের লাগাম টানা হচ্ছে। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের চেয়ে ১ শতাংশ কমিয়ে বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা আগামী অর্থবছরে ৯ শতাংশ ধরা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে এ খাতের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ১০ শতাংশ আছে।
এ ছাড়া আগামী অর্থবছরের ব্যাপক মুদ্রা সরবরাহের লক্ষ্যমাত্রা ৯ দশমিক ২ শতাংশ ধরা হয়। যদিও চলতি অর্থবছরে এর লক্ষ্যমাত্রা হলো ৯ দশমিক ৭ শতাংশ। অর্থাৎ বাজার মুদ্রা সরবরাহে লাগাম টানবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পাশাপাশি চলতি অর্থবছরের চেয়ে ২ দশমিক ২ শতাংশ কমিয়ে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য মোট অভ্যন্তরীণ ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে ১১ দশমিক ৭ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে এর লক্ষ্যমাত্রা ধরা আছে ১৩ দশমিক ৯ শতাংশ।
নতুন বাজেট প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ ও পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর সময়ের আলোকে বলেন, ‘এবারের বাজেট নিয়ে সরকার উভয় সংকটে আছে। একদিকে আয় বাড়ানোর চাপ, অন্যদিকে দেশের মানুষকে পণ্যমূল্য কমিয়ে কিছুটা স্বস্তি দেওয়ার চাপ। সব চাপ সামাল দেওয়ার জন্য সরকার ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটটি কেমন দেয় সেটি দেখার অপেক্ষায় আছি। তবে এখন পর্যন্ত যে আভাস পেয়েছি-তাতে এবারের বাজেটে সরকার অনেক ঝুঁকি নিতে হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে।’