রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর সক্রিয় জামায়াতে ইসলামী অপরাপর ইসলামী দলগুলোকে নিয়ে একটি নির্বাচনী জোটের দিকে এগোতে চাইছে। সেই লক্ষ্যে তৎপরতাও শুরু করেছে দলটি। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে আওয়ামী লীগশূন্য অবস্থাকে বড় সুযোগ হিসাবে দেখছেন জামায়াত নেতারা। তারা বলছেন, ইসলামী দলগুলোর ঐক্যবদ্ধ হওয়ার এখনই সুবর্ণ সুযোগ।
বাংলাদেশের ইতিহাসে ইসলামী দলগুলোর জোট বেঁধে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার নজির নেই। এই দলগুলো কেউ এককভাবে, কেউ বিভিন্ন জোটে ভেড়ে ভোটে অংশ নিয়ে আসছে। ভোটের হিসাবে সবচেয়ে বড় দল জামায়াতও নির্বাচন করে আসছে বিএনপির সঙ্গে জোট বেঁধে।
পতনের আগে আওয়ামী লীগ জামায়াতকে নিষিদ্ধ করলেও অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর সেই নিষেধাজ্ঞা উঠে যায়। তবে নির্বাচন কমিশনে জামায়াতের নিবন্ধন এখনও ফেরেনি, ফলে দলীয়ভাবে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ এখনও তাদের নেই।
নির্বাচন কবে হবে, তার সময় সম্পর্কে কোনও ধারণা এখনও পাওয়া না গেলেও তার আগেই আইনি প্রক্রিয়ায় নিবন্ধন ফিরে পাওয়ায় আশাবাদী জামায়াত। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের ১৫ দিন পর গত ২০ আগস্ট ঢাকার মগবাজারে দলীয় কার্যালয়ে আলেম-উলামা, পীর-মাশায়েখের সঙ্গে মতবিনিময় সভা করে ইসলামি দলগুলোর ঐক্যের আহ্বান জানান জামায়াতের আমির শফিকুর রহমান। বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের জোট এখন না থাকায় তাদের নতুন এই উদ্যোগ রাজনৈতিক অঙ্গনে কৌতূহল তৈরি করেছে।
বরফ ভাঙার প্রয়াস জামায়াতের
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী দল হিসাবে জামায়াতকে নিয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে যেমন প্রশ্ন রয়েছে তেমনি তাদের আদর্শিক অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে বিভিন্ন ইসলামী দলেরও। ইসলাম নিয়ে জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা আবুল আলা মওদুদীর ব্যাখ্যা নিয়েও আপত্তি রয়েছে ইসলামী অনেক চিন্তাবিদের। গত ২০ আগস্টের সভায় সব মতভেদ ভুলে ঐক্যের আহ্বান জানান জামায়াত আমির শফিকুর।
তিনি বলেন, “এখন থেকে আমরা সবাই একে অপরের জন্য। সবাই সীসাঢালা প্রাচীরের ন্যায় ঐক্যবদ্ধ থাকব, ইনশাআল্লাহ। “অতীতের কোনও আচরণের জন্য আপনারা যদি সামান্য কষ্ট পেয়ে থাকেন, আল্লাহর ওয়াস্তে আপনাদের কাছে ক্ষমা চাই। আশা করি, আপনারা আমাদের ক্ষমা করে দেবেন।”
জামায়াত আমিরের ডাকা সেই মতবিনিময়ে অংশ নিয়েছিলেন মুফতি মহিউদ্দীন কাসেমী, মুফতি খুরশিদ আলম কাসেমী, মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী, মুফতি রেজাউল করীম আবরার, মাওলানা আব্দুল মজিদ আতহাবী, মুফতি আজহারুল ইসলাম, মুফতি ফখরুল ইসলাম, মুফতি রাদেশ বিন নূর, মাওলানা মুনির হোসাইন কাসেমী, মাওলানা আবু জাফর কাসেমী, মাওলানা মুফতি আবুল কালাম, মাওলানা শাহ আরিফ বিল্লাহ সিদ্দিকী, মাওলানা আব্দুল মোমেন নাসেরী, মাওলানা আবুল কাশেম কাসেমী, ইসলামি বক্তা মাওলানা আলী হাসান উসামা প্রমুখ।
এরপর জামায়াত ধারাহিকভাবে বৈঠক করে বিভিন্ন ইসলামি দলের নেতাদের সঙ্গে। তার মধ্যে ছিল ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশ, লেবার পার্টি, খেলাফত মজলিস ও ফরায়েজি আন্দোলনের নেতারা। মাজারভিত্তিক সংগঠন জাকের পার্টি, ১২ দলীয় জোটের শরিক দল হিসেবে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, ইসলামী ঐক্যজোটের একাংশের নেতাদের সঙ্গেও বৈঠক করেন জামায়াত আমির।
নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত ইসলামি দলের মধ্যে রয়েছে- বাংলাদেশ তরীকত ফেডারেশন, ইসলামী ঐক্যজোট, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট, জাকের পার্টি, খেলাফত মজলিস, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ, ইসলামী আন্দোলন, ইসলামিক ফ্রন্ট, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ (বিএমএল), ইসলামী ঐক্যজোট, ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ, ইনসানিয়াত বিপ্লব বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি৷ তাদের অনেকের সঙ্গে জামায়াত আলোচনায় বসেছে।
জামায়াতের মুখপাত্র মতিউর রহমান আকন্দ বলেন, “ঐক্যের চিন্তা আমাদের অনেক আগে থেকেই ছিল। “যারা দেশে সুশাসন ও ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চায়, তারা অবশ্যই ঐক্যবদ্ধ হবে। এই আহ্বানের মাধ্যমে আমরা মনে করি, আইস ব্রেক হলো। এখন কেবল একতার দরকার।”
কী ভাবছে দলগুলোর নেতারা
২০ আগস্টের বৈঠক শুরু হয়েছিল ইসলামী বক্তা আলী হাসান ওসামার বক্তব্য দিয়ে। ঐক্যবদ্ধ হওয়া নিয়ে তিনি বলেন, “মূলত জামায়াতের আমন্ত্রণে আমরা সেখানে গিয়েছিলাম। ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সূত্রপাত সেখান থেকেই। বিভিন্নজন বিভিন্ন মত দিয়েছেন। ইসলামিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় জোর দিয়ে বলেছেন যে সেটা জামায়াতের নেতৃত্বেই সম্ভব। “তবে যেটা মূখ্য আলোচনা ছিল, তা হলো ইসলামিক ঐক্য, ইসলামিক শক্তিতে রূপান্তরিত হওয়া।”
কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব আজিজুল হক ইসলামাবাদীও সব ইসলামী দলের এক ছাতার নিচে আসার পক্ষে। জামায়াতের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হবেন কি না- এই প্রশ্নে তিনি বলেন, “এখন সময় ইসলামিক শান্তি প্রতিষ্ঠার, আর তার জন্য ঐক্যবদ্ধ হওয়ার বিকল্প নেই।
“আগামী সংসদ নির্বাচনে ইসলামপন্থী দলগুলোর ব্যালট আলাদা হতে পারে, কিন্তু নির্বাচনী সমঝোতা হবে। আমরা আলোচনার বিষয়বস্তু পর্যালোচনা করে দেখছি। তবে এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেওয়ার মতো সময় হয়নি।” খেলাফত মজলিসের যুগ্ম মহাসচিব আতাউল্লাহ আমীনও একই রকম কথা বলেন। তিনি বলেন, “আমরা ঐক্যের পক্ষে। কিন্তু এখনও অনানুষ্ঠানিক আলোচনা হচ্ছে। অর্থবহ কিছু পেতে হলে আনুষ্ঠানিক আলোচনা প্রয়োজন।”
খেলাফত মজলিসের মহাসচিব আহমদ আব্দুল কাদের বলেন, ঐক্য ও সামগ্রিক বিষয় নিয়ে এক ধরনের আলোচনা হলেও নির্বাচন নিয়ে আনুষ্ঠানিক কোনও কথা জামায়াতের সঙ্গে এখনও হয়নি। তিনি বলেন, “নির্বাচনে সব ইসলামি দলের এক আসনে এক প্রার্থী- এই হিসাবে যদি সামগ্রিক ঐক্য করা যায়, তাহলে একটা কিছু হতে পারে। না হলে কিছু হবে না। এটার মানে এই না যে জোট করা।”
মুসলিম লীগের স্থায়ী কমিটির সদস্য আনোয়ার হোসেন আবুড়ী জামায়াতের সঙ্গে জোট গঠন নিয়ে হ্যাঁ কিংবা না কিছুই এখন বলতে চাননি।
তিনি বলেন, “সরকারের পতন না হওয়া পর্যন্ত আমরা বলেছিলাম যে মাঠে থাকব, আমরা ছিলাম, ঠিক একইভাবে সুশাসন প্রতিষ্ঠা হওয়ার জন্যও আমরা সমানভাবে আছি। তবে এর জন্য জোট হবে কি না, সেটা বলার সঠিক সময় এখনও হয়নি।” ইনসানিয়াত বিপ্লব বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ইমাম হায়াতও একই সুরে বলেন, “জোট নিয়ে এখনও ভাবিনি। মতাদর্শের মিল হলে অবশ্যই আমরা ঐক্যবদ্ধ হব।”
জামায়াতের উদ্যোগে জোটে শরিক হবেন কি না- প্রশ্নে সুপ্রিম পার্টির চেয়ারম্যান সৈয়দ সাইফুদ্দীন আহমদ মাইজভান্ডারী বলেন, “দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। “তাছাড়া সুপ্রিম পার্টি ও লিবারেল ইসলামিক জোটের সঙ্গে সমমনা সুন্নি, সুফিবাদী দলগুলোর সঙ্গে জোট হতে পারে।”
তরীকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ নজীবুল বশর মাইজভান্ডারী বলেন, জামায়াতের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার উদ্যোগ সম্পর্কে তারা কিছু জানেন না। মাজারভিত্তিক এই দলটি আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটে ছিল।
আওয়ামী লীগের সঙ্গে ছিল, এমন গুটিকয়েক ইসলামি দল ছাড়া বাকি সবার ঐক্য সম্ভব বলে মনে করেন ইসলামি আন্দোলনের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব গাজী আতাউর রহমান। জামায়াতের নেতৃত্বে এক হওয়া নিয়ে তিনি বলেন, “বিষয়টি নিয়ে প্রাথমিক পর্যায়ে আলোচনা হয়েছে। দেখা যাক কী হয়। বলার মতো কোনও পর্যায়ে এখনও আসেনি।” ভোটের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ এই দলটির জ্যেষ্ঠ নায়েবে আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীম অবশ্য ঐক্য না করার বিষয়ে অবস্থান জানিয়েছেন বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে।
সে বিষয়টি তুলে ধরলে তা নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাননি চরমোনাই পীরের নেতৃত্বাধীন এই দলটির নেতা গাজী আতাউর। গত ১১ সেপ্টেম্বর এক দৈনিককে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ফয়জুল করিম বলেছিলেন, “জামায়াতের সঙ্গে আমাদের মতাদর্শগত বিরোধ। এটা শুরু থেকেই, এখনও আছে। শুধু আমাদের সঙ্গেই নয়, আরও অনেকের সঙ্গেই তাদের আদর্শগত মতবিরোধ রয়েছে।
“জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্ব নিয়ে আমাদের অনেক প্রশ্ন আছে, ১৯৭১ সালে তাদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন আছে, আকিদার প্রশ্ন আছে। এছাড়াও ওলামায়ে কেরামের মতামতের সঙ্গে জামায়াতের শীর্ষ নেতা মওদুদী সাহেবের যে মতামত, তা নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে। কওমি, পীর-মুরিদ এসব ইস্যুতেও জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে মতবিরোধ রয়েছে।”
জামায়াতের মতাদর্শিক অবস্থান নিয়ে ইসলামি দলগুলোর বেশিরভাগেরই আপত্তি রয়েছে। কওমি শিক্ষাভিত্তিক দল এবং মাজারভিত্তিক দল- দুই তরফেই রয়েছে আপত্তি। জামায়াত আমিরের ডাকে সভায় গিয়েছিলেন, এমন এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা আবুল আলা মওদুদীর কিছু লেখা বা বক্তব্য নিয়ে যে আপত্তি রয়েছে, সেগুলোর সুরাহা কীভাবে হবে, সেই প্রশ্নও আছে অনেকের মধ্যে।
“ইসলাম সমগ্র মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ করবে, এটা মহব্বত। কিন্তু একসঙ্গে পথ চলার জন্য আদর্শিক জায়গাটাও সমান ও মসৃণ হওয়া উচিৎ বলে আমি মনে করি। কিছু ইস্যু আছে, এগুলো কীভাবে সুরাহা হবে, সেটা নিয়ে সময় হলে বসতে হবে।” বিএনপির কাছছাড়া হয়ে জামায়াত নিজেদের জোর বাড়াতে অন্য দলগুলোকে তার সঙ্গে ভেড়াতে চাইছে বলেও ইসলামী দলগুলোর কোনও কোনও নেতা মনে করেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাদের একজন বলেন, “তারা এখন বিএনপিকে টেক্কা দিতে চায় ভোটের মাঠে, তাই চায় শক্তি বাড়াতে। সেই উদ্দেশ্যেই এই আহবান। অনেকেই গিয়েছে। আমরাও গিয়েছি, তবে সেটা তো আনুষ্ঠানিকতা কেবল। “আমি মনে করি, এই বৈঠকের তেমন কোনও সাড়া নেই। থাকারও কথা না। নানা বিষয় মাথায় রাখতে হবে। দেখতে হবে, বুঝতে হবে। আর সবাই সেটা দেখতেও পাচ্ছে।”