পুলিশে চাকরি করে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন যশোরের এক সময়ের আলোচিত টিএসআই রফিক। আইনি জটিলতা এড়াতে তিনি স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ করেছেন স্ত্রী ঝর্না ইয়াসমিনের নামে। নিজ নামে ৫৩ লাখ ২৭ হাজার ৩০০ টাকার স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ করলেও স্ত্রীর নামে গড়েছেন ১১ কোটি ২১ লাখ ৯১ হাজার ৬৮৮ টাকার সম্পদ।
প্রাপ্ত তথ্য মতে, অবৈধ আয় বৈধ দেখাতে স্ত্রীর নামে ইয়াসমিন এন্টারপ্রাইজ ও মায়ের দোয়া নামে দুটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়েন টিএসআই রফিক। দুই প্রতিষ্ঠানের নামে রূপালী ব্যাংক যশোর শাখা থেকে লোন নেন ৯৮ লাখ টাকা। সুদসহ হয়েছে এক কোটি টাকা। এ দেনার টাকা বাদ দিলেও ১০ কোটি টাকার সম্পদ আছে ঝর্না ইয়াসমিনের নামে। এ হিসেবে রফিকের চেয়ে তার স্ত্রী সম্পদ ১৯ গুণ বেশি। অবশ্য এ কৌশলেও পার পাননি রফিক দম্পত্তি। তাদের দুইজনের নামেই পৃথক দুটি মামলা করেছে দুদক। গতকাল দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সমন্বিত যশোর জেলা কার্যালয়ের উপসহকারী পরিচালক জালাল উদ্দিন এ মামলা করেছেন।
সূত্র মতে, গোপালগঞ্জের উত্তর সুকতাইল গ্রামের মৃত রত্তন আলী মোল্যার ছেলে রফিকুল ইসলাম (রফিক) ১৯৮৭ সালে ১০ অক্টোবর পুলিশের কনসটেবল পদে যোগ দেন। বিভিন্ন সময় পদন্নতি পেয়ে বর্তমানে টিআই পদে ফরিদপুর জেলা পুলিশে কর্তরত রয়েছেন। তিনি যশোর সদর ফাঁড়িতে টিএসআই ছিলেন। এসময় ব্যাপক দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হন। জমি, বাড়ি, গাড়ি ক্রয় করেন প্রায় প্রতি বছরই। বিশেষ করে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই তাদের সম্পদ বাড়ে হু-হু করে। বুদ্ধি করে রফিক নিজের নামে সম্পদ কিনেছেন কম। বেশিরভাগই ক্রয় করেন স্ত্রী ঝর্না ইয়াসমিনের নামে।
রফিকের জন্মস্থান গোপালগঞ্জে ১৯টি দলিলে নিজ নামে ক্রয় করেন ২৫২ শতক জমি। তার হিসেবে এ জমির দাম মাত্র ১২ লাখ ৫০ হাজার ৯২৫ টাকা। এছাড়া অস্থাবর হিসেবে তার আছে আরো আড়াই লাখ টাকা। তিনি এ হিসাব দিলেও দুদক অনুসন্ধানে পেয়েছে ৫৩ লাখ ২৭ হাজার ৩০০ টাকার সম্পদ। তার সম্পদের চেয়ে স্ত্রীর সম্পদ ১৯ গুণ বেশি।
দুদকের হিসেবে রফিকের স্ত্রীর নামে ৫ কোটি ১৭ লাখ ৪২ হাজার ৬০৪ টাকার স্থাবর সম্পদ ও ৬ কোটি ৪ লাখ ৪৯ হাজার ৮৪ টাকার অস্থাবর সম্পদসহ সর্বমোট ১১ কোটি ২১ লাখ ৯১ হাজার ৬৮৮ টাকার সম্পদ রয়েছে। এরমধ্যে স্ত্রীর ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ইয়াসমিন এন্টারপ্রাইজ ও মায়ের দোয়া নামে ব্যাংকে দেনা আছে এক কোটি টাকা।
দুদকের হিসেবে রফিকের স্ত্রী ঝরণা ইয়াসমিনের গোপালগঞ্জ পৌরসভার খাটরা মৌজায় ২ দশমিক ৩৩ শতক ও শ্যালিকার নামে ৪ দশমিক ৬৭ শতক জমি ক্রয় করা হয়েছে ২০১৭ সালে। জমিটির মূল্য দেখানো হয় ১৯ লাখ ১৭ হাজার ৬৬৬ টাকা। স্থাপনার মূল্য ১ কোটি ৪৪ লাখ ১৬ হাজার ৩৬৬ টাকা। ২০১৮ সালে যশোর পৌরসভার বারান্দি মৌজায় ক্রয় করা হয় ৬ দশমিক ৬৭ শতক জমি। যার মূল্য দেখানো হয় ১৯ লাখ ২৯ হাজার টাকা। ২০১৪ ও ২০১৬ সালে ঢাকা সিটি কর্পোরেশন সেনপাড়া পার্বত্য মৌজাতে ৮ দশমিক ২৪ কাঠার মধ্যে ৯০ দশমিক ৬ শতাংশ জমির মূল্য দেখানো ১১ লাখ ১২ হাজার ৫৭১ টাকা। ফ্লাট নির্মাণ ৫০ লাখ টাকা।
২০০৫ সালে ঢাকা জেলার বিলামালিয়া মৌজাতে ৬ দশমিক ৫০ শতক জমি ক্রয় করা হয়। যার মূল্য দেখানো হয় ৮৮ হাজার টাকা। ২০১৪ সালে খুলনা সিটি কর্পোরেশন মুজগুন্নি আবাসিক মৌজাতে শুন্য দশমিক ৬৬১ একর। যার মূল্য দেখানো হয় ১০ হাজার টাকা। ১৯৯৭ সালে খুলনা ফুলতলার ৯ নাম্বার মশিয়ালিতে ৭ শতক জমি যার মূল্য দেখানো হয় ৭৩ হাজার ৫০০ টাকা। ২০১২ সালে রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন হড়গ্রাম মৌজাতে শূন্য দশমিক ০৩০৮ একর জমি মূল্য ১০ লাখ টাকা। ২০১৮ সালে যশোর সদরের পাগলাহ মৌজাতে ১৯১ শতক জমির মূল্য দেখানো হয় ১১ লাখ ৮৭ হাজার ২০০ টাকা। ২০১৫ সালে খুলনার ফুলতলা মশিয়ালি মৌজাতে এক একর এর ১/২ ৫০ শতক স্ত্রীর নামে বাকী অংশ শ্যালিকার নামে ক্রয় করা। যার মূল্য দেখানো হয় ৮ লাখ ৫৭ হাজার ৫০০ টাকা, অবশিষ্ট মূল্য ৮ লাখ ৫৭ হাজার ৫০০ টাকা। যশোর সদরের পাগলাদাহ মৌজাতে ৮৫ শতক জমি যার মূল্য দেখানো হয় ৪০ লাখ ১১ হাজার ৭০০ টাকা। স্থাপনার মূল্য ৮৯ লাখ ১৫ হাজার ২২৩ টাকা।
২০১৮ সালে ক্রয় করা যশোর পৌরসভার বারান্দি মৌজাতে ১ দশমিক ০৩৮ শতক জমির মূল্য ১৩ লাখ ৪৫ হাজার ৯০০ টাকা। স্থাপনার মূল্য ৯২ লাখ ০৩ হাজার ৬৪৭ টাকা। একই স্থানে ৬ দশমিক ৫০ শতকের বাড়ির মূল্য ৩৩ লাখ ৬৪ হাজার টাকা। মোট ৪২৯ দশমিক ৫৪৪ শতক জমি যার মোট মূল্য ৫ কোটি ৮২ লাখ ৩৬ হাজার ৩৭০ টাকা।
এসব সম্পদের মধ্যে ইয়াসমিনের নামে ঢাকায় একটি ফ্ল্যাট, গোপালগঞ্জে একটি সাত তলা বিশিষ্ট বিল্ডিং, যশোর সদর উপজেলায় ছয় তলা ও দুই তলা বিশিষ্ট দুইটি স্থাপনা এবং যশোর সদরের পাগলাদাহ গ্রামে ২৭৮ শতক জমির উপর মায়ের দোয়া গো-খামার রয়েছে। সেখানে মোট নির্মাণ ব্যয় হয়েছে (প্রকৌশলী দিয়ে স্থাপনাসমূহ পরিমাপ করে) ৩ কোটি ৪৮ লাখ ৪৫ হাজার ৫৬৭ টাকা। এছাড়া জেলা প্রাণি সম্পদ অফিসে খামারের লাইসেন্স করার সময় তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ১৫৮টি গাভীর মূল্য ৩ কোটি ১৬ লাখ টাকা।
দুদকের স্পেশাল পিপি সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘যশোরের বহুল আলোচিত টিএসআই রফিকুল ইসলাম ও তার স্ত্রী ঝরণা ইয়াসমিন স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি ক্রোকের জন্য আদালতে আবেদন করে দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয় যশোর। শুনানি শেষে আদালত সব সম্পত্তিই ক্রোকের আদেশ দেন।
দুদক সমন্বিত যশোর জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক আল আমিন বলেন, সম্পদ অর্জনের তথ্য গোপন ও জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের প্রমাণ পাওয়ায় প্রধান কার্যালয়ের অনুমোদনক্রমে রফিক ও ঝর্না ইয়াসমিনের নামে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন ২০০৪ এর ২৬(২) এবং ২৭ (১) ধারায় পৃথক দুটি মামলা করা হয়েছে।