এলাহী নেওয়াজ খান: আমার ৪৫ বছরের সাংবাদিক জীবনে বিখ্যাত বহু রাজনৈতিক নেতা ও নেত্রীর সঙ্গে পরিচয় হয়ছে। সেই পরিচয়ের সুবাদে পরবর্তীতে অনেকের সঙ্গে গড়ে উঠেছিল অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন তরিকুল ইসলাম। অর্থাৎ আমাদের প্রিয় তরিকুল ভাই । তিনি ছিলেন এক অসাধারণ জননন্দিত নেতা। যার জীবন যাপনে ছিল না অতিশয়তা। ছিল না আড়ম্বর। অতি সাধারণ বেশভূষা ও চলনে- বলনে সাদামাটা ভাব তাকে আরো মহিয়ান করে তুলেছিল। তাই প্রথমে তিনি যশোরে যেমন অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত হয়েছিলেন তেমনি পরবর্তীতে জাতীয় রাজনীতেও এক বিশাল নেতা হিসাবে আবির্ভূত হন।
এমন একটা সময় ছিল, তখন মনে হতো যশোরের রাজনীতি মানে তরিকুল ইসলাম। ৬০-এর দশকে যশোরের ছাত্র রাজনীতি আবর্তিত হতো তরিকুল ভাইয়ের নেতৃত্বে। তখন আরেকজন নেত্রীর আবির্ভাব ঘটেছিল, তার নাম নার্গিস বেগম। তাঁরা উভয়ই ছিলেন ছাত্র ইউনিয়ন মেনন গ্রুপের নেতা-নেত্রী। আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনের সেই অগ্নিঝরা দিনগুলোতে তাদের সাহসী নেতৃত্বের কারণে সারা দেশেই তাদের নাম ছড়িয়ে পড়েছিল। এই জুটির বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার ঘটনাও তখন কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছিল। নার্গিস বেগমকে সবাই নার্গিস আপা বলে ডাকতো। শেষ পর্যন্ত তিনি বেগম হারিয়া শুধু নার্গিস আপা হয়ে উঠেছিলেন।
তরিকুল ভাইয়ের রাজনৈতিক জীবনের কঠিন দিনগুলোতে তাঁর পাশে ছিলেন নার্গিস আপা। এখানে উল্লেখ করতে হয় যে, প্রত্যেক সফল রাজনৈতিক নেতার পিছনে অনেকটা অভিভাবকের মত কাজ করে থাকে স্ত্রীর অবিচল সমর্থন। নার্গিস আপাও ঠিক সেরকম একজন ছিলেন। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, তরিকুল ভাই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে প্রগতিশীল বাম রাজনীতি ত্যাগ করে বিএনপির মত গণতান্ত্রিক বুর্জোয়া রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হলেও কখনো আভিজাত্যের বড়াই করতেন না। সাদামাটা জীবন যাপন করতেন।
সাংবাদিকদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল খুব নিবিড়। ২০০২- ৩ সালের দিকের ঘটনা। আমি তখন ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) সভাপতি। আমরা দুই ইউনিয়ন মিলে ষষ্ঠ ওয়েজবোর্ডের জন্য সবে আন্দোলন শুরু করেছি। হঠাৎ একদিন আমার মন হলো আন্দোলন ছাড়া ‘ওয়েজবোর্ড’ আদায় করা যায় কিনা। যেমন চিন্তা তেমনই চলে গেলাম তরিকুল ভাইয়ের কাছে। তখন তিনি বেশ ক্ষমতাধর তথ্যমন্ত্রী। আমি তাকে বিষয়টি বুঝিয়ে বললাম। তিনি মনোযোগের সঙ্গে বিস্তারিত শুনে স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে যশোরের স্থানীয় একটি শব্দ ব্যবহার করে বললেন, তুমুল আন্দোলন গড়ে তুলুন। আমি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলাপ করে ‘ওয়েজবোর্ড’ গঠন করে দেব। তিনি বললেন, শিশু না কাঁদলে মাও তো দুধ দেয় না। আমি বুঝে নিলাম ‘ওয়েজবোর্ড’ হবে; কিন্তু আমাদের একটু খাটতে হবে। পরবর্তীতে আমি সাংবাদিক নেতাদের বললাম, তথ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আমার কথা হয়েছে- আন্দোলন চালিয়ে গেলেই আমরা ‘ওয়েজবোর্ড’ পেয়ে যাবো। হলোও তাই। আমাদের প্রচন্ড আন্দোলনের মুখে সরকার ‘ওয়েজবোর্ড’ গঠনের ঘোষণা দিয়ে দেন।
আরো অনেক টুকরো টুকরো স্মৃতি আছে। একটি ঘটনা খুব মনে পড়ছে। একটি ইফতারির অনুষ্ঠান নিয়ে আমি খুব বিপদে পড়েছিলাম। কিছু না বলা সত্বেও নিজের উদ্যেগে কিভাবে তরিকুল সে বিপদ থেকে আমাকে উদ্ধার করেছিলেন তা এখনো আমার স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করছে। এখানে উল্লেখ করতে হয় যে, প্রতি বছর ডিইউজে ও বিএফইউজের উদ্যেগে আয়োজিত ইফতার মাহফিলে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া অংশ গ্রহন করে থাকেন। আর আমি যে সময়ের কথা বলছি তখন তিনি ছিলেন দেশের প্রধানমন্ত্রী। তিনি ইফতার মাফিলে প্রধানঅতিথি হিসাবে যোগ দিবেন। বিরাট আয়োজন করা হয়েছে। কিন্তু টাকা জোগাড় করতে হিমশিম খাচ্ছিলাম। টেনশনে রাতের ঘুম হারাম হয়ে গিয়েছিলাম। ইফতার অনুষ্ঠানের দু-দিন আগে সন্ধ্যায় হঠাৎ তরিকুল ভাইয়ের ফোন পেলাম। তড়িঘড়ি করে উনার মিন্টু রোডস্থ সরকারী বাসায়
গিয়ে উপস্থিত হলাম। এপিএস শামসুল সরাসরি উনার রুমে নিয়ে গেল। তরিকুল ভাই দাঁড়িয়ে আমাকে অভ্যর্থনা জানালেন। অদ্ভুত এক আন্তরিকতা ছিল সেই অভ্যর্থনায়।
তারপর দীর্ঘ সময় আমরা নানা বিষয়ে কথা বলতে অনেক রাত হয়ে গেলে। আমি বললাম, আজ উঠি তরিকুল ভাই, রাত প্রায় ১১টা বেজে গেছে। কিন্তু আমি যে আশা নিয়ে গিয়েছিলাম সে ব্যপারের কোনো কথা না শোনায় আমি হতাশ হয়ে পড়েছিলাম। আমি উঠে দড়ালাম। আমার সঙ্গে ছিল সিনিয়র সাংবাদিক শফিক। খুলনার ছেলে। সেও আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। হঠাৎ তরিকুল ভাই টেবিলের ড্রয়ার খুলতে খুলতে বললেন, আপনার তো কোনো মুরোদ নেই, কিভাবে ইফতার মাহফিল করবেন। তারপর ড্রয়ার থেকে একটা এনভেলপ বের করে আমার হাতে দিয়ে বললেন, কিছুটা হলেও কাজে লাগবে।
আমার যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছোটার অবস্থা হলো। এনভেলপে ৫০ হাজার টাকা ছিল। আমার অন্তর জুড়ে একটা প্রশান্তি নেমে আসলো। যেন অন্ধকার থেকে আলোয় আসলাম। আসলে এরকমই ছিলেন তরিকুল ভাই। যে কাছ থেকে দেখেছে সেই জেনেছে যে, তরিকুল ভাই একজন রাজনৈতিক নেতা হিসাবে কতটা গণমুখী ছিলেন। আমি তার আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি।